বাটিক শিল্পে ক্যারিয়ার গড়ুন



বাটিক প্রিন্টের নানান কথা
সুন্দরের প্রতি মানুষের আকর্ষণ চিরন্তন। সেকারণেই মানুষ তা সৌন্দর্যবোধের প্রকাশ ঘটায় রং ও নকশার বিভিন্ন ব্যবহারের মাধ্যমে। রঙিন ও প্রিন্টের কাপড় এর অন্যতম। সুদূর অতীতে যখন কাপড় ছাপানোর যন্ত্র ছিল না, তখন মানুষ হাতেই নানাভাবে কাপড় প্রিন্ট করত। যেমন ব্লক, বাটিক, টাইডাই ইত্যাদি। সেই প্রাচীনকাল থেকে আজ অবধি এসব কাপড় ছাপানোর পদ্ধতি প্রচলিত রয়েছে।
কাপড়ের কিছু অংশে নকশা এঁকে তারপর নকশাটি মোম দিয়ে ঢেকে সেটা রঙে ডুবিয়ে যে পদ্ধতিতে কাপড় রং করা হয় তাকে বাটিক প্রিন্ট বলে। এক্ষেত্রে মোম লাগানো অংশে রং ঠিকমতো প্রবেশ করতে পারে না। ফলে তা অনবদ্য রূপলাভ করে। বাটিক প্রিন্ট শুধু কাপড়েই নয়, চামড়ার ওপরেও করা যায়।
বাটিক ছাপার ইতিহাস ও উত্‍স সম্পর্কে সঠিকভাবে তেমন কিছু জানা যায়নি। তবে ধরে নেয়া হয় যে, প্রাচ্য দেশসমূহ বিশেষ করে ইন্দোনেশিয়ার জাভা, বালি ও তত্‍সংলগ্ন এলাকাগুলোতে প্রথম এই কাজের প্রচলন ঘটে। এমন ধারণার অন্যতম কারণ হলো, বাটিক শব্দটি ইন্দোনেশিয়ান ভাষা থেকে এসেছে। এই শব্দটি বাংলা করলে দাঁড়ায় একটি বিন্দু বা একটি ফোঁটা। বিন্দু বিন্দু মোমের সাহায্যেই ইন্দোনেশিয়ান বাটিক করা হতো।
তবে পুরোনো ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, ভারতীয় উপকূল থেকে বাটিকের প্রথম উত্‍পত্তি। তবে এর উত্‍কর্ষ ঘটে ইন্দোনেশিয়া থেকে চীন দেশে সপ্তম শতাব্দীর প্রথম দিকে। এছাড়াও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, ইউরোপের কিছু অংশ, জাপান এবং অস্ট্রেলিয়ার কিছু অংশে বাটিকের কাজের প্রচলন দেখা যায়। বর্তমানে বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই বাটিক ছাপা ব্যাপকভাবে প্রচলিত এবং সর্বত্রই তা সমাদৃত।

বাটিক অতি প্রাচীন একটি শিল্প। এ শিল্প প্রায় আড়াই হাজার বছরের পুরনো। গ্রীক সভ্যতাতেও বাটিকছাপার কাপড় ব্যবহার হতো বলে নিদর্শন পাওয়া যায়। কেউ কেউ এই মতও প্রদান করেন প্রাচীন মিসরের অধিবাসীরাই এই শিল্পের পথিকৃত্‍। এরপর বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন দেশের মধ্যে সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানের মাধ্যমে বাটিক শিল্প বিস্তার লাভ করেছে। তবে কাজের পদ্ধতিতে একটি দেশের থেকে অপর একটি দেশের কিছুটা পার্থক্য থাকতে পারে। কিন্তু মূল বিষয়বস্তু একই থাকে। তবে বাটিকের ক্ষেত্রে ভারতীয় মতটাই অধিক প্রচলিত। ভারতে বাটিক শিল্পের উত্‍পত্তি নিয়ে একটি গল্পও প্রচলিত রয়েছে -
একদিন এক মহিলা পুকুর ঘাটে হরতকী গাছের নিচে তাঁর পরিধানের বস্ত্র খুলে গোসল করতে পুকুরে নামেন। তিনি লক্ষ্য করেন যে, কিছু মৌমাছি তাঁর কাপড়ের উপর ঘুরে বেড়াচ্ছে। গোসল শেষে তিনি কাপড়টি পরতে গিয়ে দেখলেন যে, কাপড়ের ওপরে মৌমাছিদের মোমের দাগ। তাই তিনি সেই কাপড়টি পরিষ্কার করার জন্য হরতকী গাছের ঠিক নিচেই পুকুরের পানিতে কাপড়টি ধোয়ার চেষ্টা করলেন। এতে দেখা গেল যে, কাপড়ের যে জায়গাগুলোতে মৌমাছি দ্বারা মোম লেগে গিয়েছিল সেই জায়গাগুলি সাদা রয়ে গেছে এবং বাকি জায়গা হরতকীর রঙে খাকি রং হয়ে গেছে। সাদা অংশগুলোর জন্য কাপড়ে এক ধরনের নকশার সৃষ্টি হয়েছে। বলা হয়ে থাক এ ঘটনার ফলেই ভারতীয় উপকূল অঞ্চল সর্বপ্রথম বাটিক শিল্পের জন্ম হয়।

বাংলাদেশে বাটিক হস্ত ও কারুশিল্প হিসেবে ব্যাপক জনপ্রিয়। ষাটের দশকে গুটিকয়েক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এ শিল্প বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এর জনপ্রিয়তা ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে এখন পর্যন্ত সমান রয়েছে! বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গে বাটিক শিল্পের যে চাহিদা রয়েছে, তার মূলে রয়েছেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনিই ইংরেজ শাসনের শেষ দিকে বাঙালিদের এই শিল্পের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ হন। শান্তিনিকেতন প্রতিষ্ঠার পর কবি কায়কোবাদ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশ ভ্রমণ করেন। সেসব দেশের বাটিক শিল্প তাঁকে প্রভাবিত করে। তিনি স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের পর শান্তিনিকেতনে শিল্প ও কলা বিভাগে বাটিক শিল্প অবশ্য পাঠ্য করে দেন।

বাটিকের রং হিসেবে প্রাকৃতিক ও রাসায়নিক দু ধরনের রংই ব্যবহার করা হয়। নীল, তুঁতে, গাঁদাফুল, শিউলীফুল, পেঁয়াজের খোসা, হরতকী, খয়ের ইত্যাদি প্রাকৃতিক উপাদান থেকে বিশেষ উপায়ে রং তৈরি করে তা দিয়ে বাটিকের কাজ করা হয়। আগে শুধু সুতি কাপড়েই বাটিক করা হতো, কিন্তু এখন সুতির পাশাপাশি সিল্ক, গরদ, তসর, মসলিন, অ্যান্ডিকটন এমনকি খাদি কাপড়েও বাটিক প্রিন্ট করা হয়।
বর্তমানে বাটিক প্রিন্টের কাপড় খুব জনপ্রিয়। বিশেষ করে হাল ফ্যাশনে বাটিক প্রিন্টের উপস্থিতি বেশ চোখে পড়ার মতো। বাটিক প্রিন্টের শাড়ি, সালোয়ার-কামিজ-ওড়না, স্কার্ট, ফতুয়া, স্কার্ফ, শার্ট, পাঞ্জাবী ইত্যাদি সবই দেখতে হয় অত্যন্ত আকর্ষণীয়। ফলে তা আরামদায়ক ও ফ্যাশনেবল পোশাক হিসেবে সকলের মনে সহজেই স্থান করে নিয়েছে। বাটিকের গজ কাপড়ও পাওয়া যায় বেশ সুলভে। তাই গজ কাপড় কিনে অনেকেই বানিয়ে নেন নিজের পছন্দমতো পোশাক।

বাটিকের শাড়ি যেমন পরতে পারেন প্রতিদিনের প্রয়োজনে, তেমনি পরতে পারেন উত্‍সব-অনুষ্ঠানেও! বিশেষ করে বাটিক প্রিন্টের সিল্কের শাড়ি আপনাকে করে তুলবে অতুলনীয়! সালোয়ার-কামিজ-ওড়নাতে বাটিকের অনবদ্য কাজ পোশাকে এনে দেয় ঐতিহ্যের ছোঁয়া। জিন্স, লেংগিস বা জেংগিসের সাথে অনায়াসে পরতে পারেন বাটিক প্রিন্টের ফতুয়া বা টপস। সাথে থাকতে পারে বাটিক প্রিন্টেরই স্কার্ফ। বাটিক ছাপার স্কার্টের সাথে একরঙা টপস মানিয়ে যায় বেশ।

ছেলেদের পোশাকের ক্ষেত্রেও বাটিক প্রিন্টের তুলনা নেই! বিশেষ করে পালা-পবর্ণে বাটিকের পাঞ্জাবী যেন আবশ্যক। বাটিক প্রিন্টের শার্ট ও ফতুয়াও পোশাক হিসেবে তুলনাহীন। বিশেষ করে ক্যাজুয়াল বা সেমি-ক্যাজুয়াল পোশাক হিসেবে বাটিক প্রিন্টের হাওয়াই শার্ট বেশ জনপ্রিয়।

কোথায় পাবেন :
ক্রাফট সেন্টারগুলোতে বাটিকের গজ কাপড় বা পোশাক পাবেন। পাবেন ফ্যাশন হাউজগুলোতেও। চরকা, সোর্স, গৃহসুখন, ওয়াইএমসিএ, আরণ্যক, প্রবর্তনাতে রয়েছে বাটিকের গজ কাপড় ও পোশাকের বিপুল সমাহার। এছাড়া গাউসিয়া, চাঁদনীচক, নিউমার্কেটসহ শহরের প্রায় সব মার্কেটেই বাটিক প্রিন্টের গজ কাপড় ও পোশাক পেয়ে যাবেন।

দামদর :
বাটিক প্রিন্টের কাপড়ের দাম নির্ভর করে এর রঙের ওপরে। কাপড়ে প্রাকৃতিক রঙের ব্যবহার হলে এর দাম তুলনামূলক ভাবে বেশি হয়। সালোয়ার-কামিজ (সেলাইবিহীন) পাবেন ৪৫০-২৫০০টাকা, সেলাইসহ ১২০০-৪৫০০ টাকা, ফতুয়া ৪৫০-১৫০০ টাকা, স্কার্ট ২৫০-১২০০ টাকা, ওড়না ৩৫০-১৫০০ টাকা, স্কার্ফ ১৫০-৫৫০ টাকা, পাঞ্জাবী ৬৫০-২০০০ টাকা, শার্ট ৪৫০-১২০০ টাকা। এছাড়া প্রতি গজ কাপড় পাবেন ১১০-৪৫০ টাকার মধ্যে।

সহজে ক্যারিয়ার গড়ুন বাটিক শিল্পে
নিজের পায়ে দাঁড়া হতে, নিজের রোজগারে নিজে চলতে কে না চায়? কিন্তু সবার পক্ষে তো ঘরের বাইরে গিয়ে কাজ করা সম্ভব নয়। তবে কিছু কিছু কাজ আছে, যা ঘরে বসেই করা সম্ভব এবং অর্থ আয় করা সম্ভব। এর মধ্যে একটি হলো বাটিক শিল্প। কাপড়ের কিছু অংশে নকশা এঁকে তারপর নকশাটি মোম দিয়ে ঢেকে সেটা রঙে ডুবিয়ে যে পদ্ধতিতে কাপড় রং করা হয় তাকে বাটিক প্রিন্ট বলে। খুব স্বল্প সময়ের প্রশিক্ষণ নিয়ে যে কেউ এই শিল্পকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করতে পারে। অন্যান্য কাজের ফাঁকে ফাঁকে খুব সময়ে বাড়িতে করতে পারেন কাপড়ে বাটিক ছাপার কাজ। যে কেউ এই কাজ করতে পারে। এর জন্য শুধু প্রয়োজন কাজ করার ইচ্ছা এবং পরিশ্রম করার মানসিকতা।

কাজ শুরুর আগে :
বাংলাদেশে বাটিক হস্ত ও কারুশিল্প হিসেবে ব্যাপক জনপ্রিয়। ষাটের দশকে গুটিকয়েক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এ শিল্প প্রতিষ্ঠা লাভ করে। বাটিক শিল্পকে পেশা হিসেবে নেবার আগে কিছু বিষয়ে লক্ষ্য রাখুন -

একটি স্বল্প মেয়াদি প্রশিক্ষণ নিয়ে নিন বাটিক প্রিন্ট সম্পর্কে। এতে আপনার কাজ সহজ হয়ে যাবে বহুগুণ।
বাটিক প্রিন্টের কাপড় ও পোশাকের বাজারদর, কারা এসব বিক্রি করে, ডিলার কারা - এসব ব্যাপারে ভালোভাবে খোঁজখবর করুন।
বাটিক প্রিন্টের বিভিন্ন উপকরণ, রং ইত্যাদি কোথায় ভালো ও উন্নতমানের এবং কম দামে পাওয়া যায় খোঁজখবর নিন। বিক্রেতাদের ফোন নম্বর মনে করে নিয়ে রাখুন যাতে পরে প্রয়োজনে সহজেই যোগাযোগ করতে পারেন।

যাদের কাছে আপনার পণ্য বিক্রিয় করবেন তাদের সাথে ভালো সম্পর্ক গড়ে তুলুন। ফ্যাশন হাউজগুলোর সাথে কথা বলুন।
নিজের প্রতিষ্ঠানের একটি নাম ঠিক করে নিন। এবং সেই প্রচার ও বিজ্ঞাপনের ব্যবস্থা করুন। প্রতিষ্ঠানের নাম, যোগাযোগের ঠিকানা ও ফোন নম্বরসহ আপনার কার্ড তৈরি করুন।

প্রশিক্ষণ :

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক), যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর, মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর বাটিকের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। বাংলাদেশের প্রায় সব জেলাতেই এসব প্রতিষ্ঠানের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র রয়েছে। এছাড়া বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠানেই এ বিষয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে। অভিজ্ঞ কারো কাছ থেকে বিস্তারিত জেনে নিয়ে কাজ শুরু করা সম্ভব।

কাজ শুরু:
কাজের শুরুতে প্রথমেই কিনে ফেলতে হবে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম। বাটিক প্রিন্টের কাজে প্রয়োজন পড়বে চুলা, মোম গলানোর পাত্র, মোম লাগানোর তুলি, ব্রাশ, বালতি, গামলা, জান্টিং, রং, মোম, রজন, ফ্রেম, স্কেল ইত্যাদি। এসব পেয়ে যাবেন যেকোনো হার্ডওয়্যারের দোকানে।
প্রয়োজনীয় উপকরণ সংগ্রহ করা হয়ে গেলে কাজ শুরু করে দিতে পারেন। প্রথম প্রথম রঙের গন্ধের কারণে কাজ করতে অসুবিধা অনুভব হলেও পরে অভ্যাস হয়ে যাবে।

মনে রাখুন :
যে কাপড়ে বাটিক করবেন তা যেন অবশ্যই মাড় ছাড়া হয়।
ভুল জায়গায় মোম পড়ে গেলে তার উপরে চোষ কাগজ রেখে গরম ইস্ত্রি ধরুন, বাড়তি মোম উঠে যাবে।
নতুন রং তৈরিতে আগে অল্প কাপড়ে রং করে দেখুন।
কাপড় প্রথমে ছায়ায় শুকিয়ে নিন। পরে মাড় দিয়ে কাপড় রোদে শুকিয়ে ইস্ত্রি করুন।
মনে রাখবেন, ভালো ব্যবহারই ব্যবসার সাফল্যের মূলমন্ত্র। তাই সকলের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখুন।

No comments:

Post a Comment