চেক ডিজঅনার হলে কোথায় যাবেন ,,বা কত দিনের মধ্যে মামলা করবেন,,

চেক ডিজঅনার হলে কি করবেন? কোথায় মামলা করবেন,,

ব্যাংকে রাখা টাকা তুলতে হলে গ্রাহককে চেক লিখতে হয়। সেই চেক গ্রাহক বা অন্য কেউ ব্যাংকে দেবার পর ব্যাংক চেকে উল্লিখিত অংকের নগদ টাকা দেয়। আধুনিককালের ক্রেডিট কার্ড এবং ক্যাশ কার্ডকেও চেকের একটি বিশেষরূপ বলা যায়।


চেক বিভিন্নভাবে লেখা যায়:
বাহক চেক:
এসব চেক যেকোন বাহক ভাঙাতে পারে।

ক্রস চেক বা একাউন্ট পেয়ী চেক:
এসব চেকে প্রাপকের নাম লিখে দেয়া হয় এবং সরাসরি তাকে টাকা না দিয়ে তার একাউন্টে জমা করা হয়। পরে প্রাপক নিজের চেক বইয়ের মাধ্যমে টাকা তুলতে পারেন।

অগ্রিম চেক:
এধরনের চেকে অগ্রিম তারিখ লিখে দেয়া হয় এবং নির্ধারিত তারিখের আগে টাকা তোলা যায় না।


চেক ডিজঅনার হওয়া:
চেকে উল্লিখিত অংকের টাকা একাউন্টে না থাকলে ব্যাংকের পক্ষে টাকা দেয়া সম্ভব হয় না এবং চেক প্রত্যাখ্যান করা হয়, যা চেক ডিজঅনার হওয়া নামে পরিচিত।


চেক ডিজঅনার হওয়া একটি অপরাধ:
ডিজঅনার হওয়া চেকের বাহক একাউন্টধারী নিজে হলে সেটা কোন অপরাধ নয়। কিন্তু যদি এমন হয় যে একাউন্টধারী অন্য কাউকে চেক লিখে দিলেন এবং সেটি ব্যাংকে প্রত্যাখ্যাত হল, তবে সেটি একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। ১৮৮১ সালের নেগোশিয়েবল অ্যাক্টের ১৩৮ এবং ১৩৯ নম্বর ধারায় এ সংক্রান্ত ক্ষেত্রে শাস্তির বিধান করা হয়। পরে ২০০০ এবং ২০০৬ সালে সংশ্লিষ্ট ধারায় কিছু পরিবর্তন আনা হয়।


আইনের কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক: 
চেক লেখার সময় থেকে ছয় মাস পর্যন্ত চেকটির মেয়াদ থাকে। তবে মেয়াদ শেষে একাউন্টধারী তারিখ কেটে পুনরায় তারিখ লিখে সাক্ষর করে মেয়াদ বাড়াতে পারেন। চেক ডিজঅনার হওয়ার ১৫ দিনের মধ্যে একাউন্টধারীকে চেক ডিজঅনার হওয়ার বিষয়টি জানিয়ে চেকে উল্লিখিত অংকের টাকা প্রদানের দাবি জানাতে হয়। আর ত্রিশ দিনের মধ্যে দাবি না জানালে সেটি আইনের দৃষ্টিতে গ্রাহ্য হয় না। নোটিশ পাওয়ার ত্রিশ দিনের মধ্যে একাউন্টধারীকে টাকা পরিশোধ করতে হয়। অন্যথায় তার বিরুদ্ধে মামলা করা যায়।

যে ক্ষেত্রে কোন লোক তার দ্বারা পরিচালিত কোন ব্যাংক একাউন্ট হতে অন্য কোন লোককে যে কোন পরিমাণ অর্থ পরিশোধের জন্য কোন চেক দেয় এবং উক্ত একাউন্টে যদি চেক কাটা টাকার পরিমানের চেয়ে কম টাকা থাকে এবং চেকটি যদি ব্যাংক অপরিশোধিত অবস্থায় ফেরত দেয় তাহলে চেকদাতা একটি অপরাধ সংঘটিত করেছে বলে গণ্য হবে এবং তিনি এক বৎসর মেয়াদ পর্যন্ত দন্ডে দন্ডিত অথবা চেকে বর্ণিত অর্থের তিনগুন পরিমাণ অর্থ দন্ডে দন্ডিত হবে অথবা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবে। তহবিল অপর্যাপ্ততার কারণে ব্যাংকের চেক প্রত্যাখ্যাত হওয়া একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

নেগোসিয়েবল ইনস্ট্রুমেন্ট অ্যাক্টের (এনআই অ্যাক্ট) ১৩৮, ১৪০ ও ১৪১ ধারায় তহবিল অপর্যাপ্ততার কারণে ব্যাংকের চেক প্রত্যাখ্যাত হওয়ার অপরাধের জন্য আইনি প্রতিকারের বিধান রাখা হয়েছে।

আমাদের দেশে চেক ডিজঅনারের মামলার পদ্ধতি সম্পর্কে বহু ভুল ধারণা রয়েছে। ফলে দেখা যায়, পদ্ধতিগত কারণে অনেকের মামলার অধিকারই নষ্ট হয়ে যায়। চেকের মামলা করতে ৩বার চেক ডিজঅনার করাতে হয় মর্মে একটি ভুল ধারণা দেশে সর্বসাধারণে প্রচলিত রয়েছে। অনেক বিজ্ঞ ব্যক্তি ও অভিজ্ঞ ব্যাংক কর্মকর্তাকেও দেখেছি চেকের মামলার জন্য গ্রাহককে ৩বার চেক ডিজঅনার করানোর পরামর্শ দিতে। এটা একটা প্রচলিত নিয়মে পরিণত হয়েছে, যা ভুল পরামর্শ। প্রকৃতপক্ষে আইনে এ ধরনের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। এ ব্যাপারে এন আই অ্যাক্টের বিধান মতে, চেক ৬ মাসের মধ্যে যেদিন ডিজঅনার হয় সে দিন থেকে ৩০ দিনের মধ্যে লিখিতভাবে লিগ্যাল নোটিশ প্রদানের বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে।

নগদ টাকার পরিবর্তে চেকের মাধ্যমে ঋণ অথবা অন্য কোনো দায় পরিশোধকে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে এ আইন করা হয়েছে। নগদ লেনদেনে রয়েছে ঝুঁকি। তা সত্ত্বেও আমাদের দেশের নগদ লেনদেনের প্রতি মানুষের ঝোঁক বেশি। চেকের মাধ্যমে লেনদেনে ঝুঁকি কম। তবে চেক প্রত্যাখ্যাত হওয়ার ঝুঁকি আছে। বিদেশে চেক অথবা ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমেই অধিকাংশ দেনা পরিশোধ করা হয়। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো চেকের মাধ্যমে লেনদেন এখনো আমাদের দেশে ততটা জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি। তবে ক্রমান্বয়ে চেক জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।

উদাহরণ:
ধরা যাক ‘ক’ এর কাছে ‘খ’ দুই লাখ টাকা পাবে। ‘ক’ টাকা পরিশোধের উদ্দেশে ‘খ’ কে জনতা ব্যাংকের একটি চেক দিল। চেকে টাকার পরিমাণও ছিল দুই লাখ। ‘খ’ টাকা উত্তোলনের জন্য যথাসময়ে চেকটি জনতা ব্যাংকে জমা দেওয়ার পর জনতা ব্যাংক জানিয়ে দিল ‘ক’ এর ব্যাংক হিসেবে পর্যাপ্ত টাকা নেই। তহবিল অপর্যাপ্ততার কারণে ‘ক’ অপরাধ করেছে। তবে আইনের এ বিধানাবলী কার্যকর করতে কতিপয় শর্ত পূরণ করতে হবে।


চেক প্রাপকের পালনীয় কর্তব্য সমূহ
ক.চেকটি প্রস্তুত হওয়ার তারিখ হতে ৬ মাসের মধ্যে অথবা চেকটি বৈধ থাকাকালীন সময়ের মধ্যে যেটি আগে হয় সেই সময়সীমার মধ্যে ব্যাংকে উপস্থাপন করতে হবে।

খ.চেকটির প্রাপক অথবা যথা নিয়মে ধারক যেই হোন না কেন ব্যাংক কর্তৃক চেকটি ফেরত কিংবা ডিস্অনার হয়েছে তা অবগত হওয়ার ত্রিশ দিনের মধ্যে চেকে বর্ণিত টাকা পরিশোধের দাবি জানিয়ে চেক প্রদানকারীকে লিখিত নোটিশ প্রদান করবেন।

গ.উক্ত নোটিশ প্রাপ্তির ত্রিশ দিনের মধ্যে চেক প্রদানকারী চেকের প্রাপককে অথবা যথা নিয়মে ধারকের বরাবর উল্লেখিত পরিমাণ টাকা পরিশোধে ব্যর্থ হলে মামলার কারণ উদ্ভব হবে।

ঘ.মামলার কারণ উদ্ভব হওয়ার তারিখ হতে এক মাসের মধ্যে মামলা দায়ের করতে হবে।


নোটিশ জারীর নিয়মাবলী
সরাসরি প্রাপক বরাবর অথবা তার সর্বশেষ বসবাসের ঠিকানা কিংবা বাংলাদেশে তার ব্যবসায়িক ঠিকানা বরাবর প্রাপ্তি স্বীকারপত্রের ব্যবস্থাসহ রেজিস্টার্ড ডাকে নোটিশ পাঠাতে হয়। এছাড়া অন্তত একটি জাতীয় বাংলা দৈনিকে নোটিশটি বিজ্ঞপ্তি আকারে প্রকাশ করতে হয়। দেনাদারের সর্বশেষ জানা সঠিক ঠিকানায় নোটিশ দিলে তা প্রাপক গ্রহণ না করলে, ফেরত আসলে, প্রত্যাখ্যান করলে তাতে মামলার কোনো ক্ষতি হবে না, তবে আইনের বিধান হচ্ছে লিখিতভাবে নোটিশ দিতেই হবে এবং নোটিশে প্রাপককে টাকা আদায়ের জন্য প্রাপ্তির দিন হতে ৩০ দিন সময় দিতে হবে। এর আগে মামলা করা যাবে না। নোটিশ গ্রহণ বা প্রত্যাখ্যানের দিন থেকে উক্ত সময় গণনা হবে।


চেকটির প্রেরক যদি কোন রেজিষ্টার কোম্পানী হয়
কোম্পানির ক্ষেত্রেও এ আইন প্রযোজ্য হবে। এনআই অ্যাক্টের ধারা ১৩৮-এ বর্ণিত অপরাধ সংঘটনকারী যদি একটি কোম্পানি হয় এবং ওই কোম্পানি যদি সংঘটিত অপরাধের জন্য দায়ী বলে প্রমাণিত হয়, তাহলে ওই অপরাধ সংঘটনের সময় দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সংঘটিত অপরাধের জন্য দায়ী হবেন এবং আইন অনুযায়ী দণ্ডিত হবেন।


যে সব কারণে চেকের অমর্যাদা হতে পারে সেগুলো হচ্ছে:
১. চেক মেয়াদোত্তীর্ণ হলে
২. যথাযথভাবে চেক পূরণ করা না হলে
৩. চেকে ড্রয়ারে স্বাক্ষর না হলে
৪. চেক পোস্ট ডেটেড অর্থাৎ পর-তারিখের হলে
৫. চেকে স্বাক্ষরের সঙ্গে ব্যাংকে রক্ষিত গ্রাহকের নমুনা স্বাক্ষরের অমিল হলে
৬. চেকে উল্লিখিত টাকার পরিমাণ অংকে ও কথায় অমিল হলে
৭. হিসাবে পর্যাপ্ত স্থিতি না থাকলে
৮. চেকে ঘষামাজা থাকলে
৯. চেকে কাটাকাটি থাকলে পূর্ণ স্বাক্ষর দিয়ে তা সত্যকরণ না করা হলে
১০. ব্যাংকিং সময়ের পর চেক উপস্থাপন করা হলে

এ ছাড়া আরো অনেক কারণে চেক প্রত্যাখ্যাত (বাউন্স) হতে পারে। যে সব কারণে চেক প্রত্যাখ্যাত হতে পারে তার একটি ছাপানো রশিদ প্রতিটি ব্যাংকে থাকে। যে কারণে চেকটি প্রত্যাখ্যাত হলো তা চিহ্নিত করে ওই স্লিপসহ চেকটি প্রাপকের কাছে ব্যাংক ফেরত পাঠায়। উল্লেখ্য, শুধু তহবিল অপর্যাপ্ততার কারণে চেক প্রত্যাখ্যাত হলে তা এই আইনের আওতায় পড়ে।


মামলা করা:
এ ধরনের মামলা একজনের পক্ষে আরেকজন করতে পারেন না। যে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে চেক দেয়া হয়েছে কেবল তিনিই মামলা করতে পারেন। মামলা করার ক্ষেত্রে তারিখ খুব গুরুত্বপূর্ণ, চেক ডিজঅনার হওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে নোটিশ পাঠাতে হয়। নোটিশ পাঠিয়ে ১৫ দিন অপেক্ষা করতে হয়। এরপর ৩০ দিনের মধ্যে মামলা করতে হয়।


যে আদালতে মামলা করতে হবে:
ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা দায়ের করতে হয় তবে বিচারের ক্ষমতা দায়রা আদালতের। এ ধরনের মামলা দায়ের করতে যেসব তথ্য প্রয়োজন হয়:
১। চেক প্রদানকারীর নাম
২। চেক প্রদানের বা লেখার তারিখ
৩। চেক ডিজঅনার হওয়ার তারিখ
৪। ব্যাংক, ব্যাংকের শাখার নাম, হিসাব নম্বর, চেক নম্বর ও টাকার পরিমাণ
৫। কোম্পানী বা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে চেক দেয়া হয়ে থাকলে ইস্যুকারী কর্মকর্তার নাম, পদবী ও প্রতিষ্ঠানের নাম।
৬। যে কারণে চেকটি ডিজঅনার করা হয়েছে।
৭। চেক ডিজঅনার হওয়ার কথা জানিয়ে নোটিশ পাঠানোর প্রমাণ এবং নোটিশ ফেরত এসে থাকলে ফেরত আসার তারিখসহ অন্যান্য তথ্য।
৮। চেক-লেনদেনের তথ্য।


যথাসময়ে মামলা দায়ের করতে না পারলে
নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নেগোশিয়েবল ইনস্ট্রুমেন্ট অ্যাক্টের অধীনে মামলা দায়ের করতে না পারলে দন্ডবিধির ৪০৬ এবং ৪২০ ধারা অনুসারে ফৌজদারী মামলা দায়ের করা যায়। তবে এক্ষেত্রে টাকা ফেরত পাওয়ার সুযোগ নেই। দোষী সাব্যস্ত হলে ৭ বছর পর্যন্ত কারাদন্ড এবং জরিমানা হতে পারে।


আপীল দায়ের
তহবিল অপর্যাপ্ততার কারণে ব্যাংক চেক প্রত্যাখ্যাত হওয়ার অপরাধে আদালত কাউকে কারাদন্ড প্রদান করলে তার বিরুদ্ধে আপিল করতে হলে প্রত্যাখ্যাত চেকের মূল্যের কমপক্ষে ৫০ শতাংশ অর্থ সংশ্লিষ্ট আদালতে জমা দিতে হবে। একাউন্টধারী চেকে উল্লিখিত অর্থের ৫০ শতাংশ পরিশোধ করতে সক্ষম হলে আপীল করা যায় না।


অপরাধের শাস্তি
আইনানুসারে এক বছরের কারাদন্ড এবং চেকে বর্ণিত অংকের তিন গুণ পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে। অন্যান্য ফৌজদারী মামলায় জরিমানার টাকা সরকারী কোষাগারে জমা হয়, কিন্তু চেক ডিজঅনার মামলায় জরিমানার টাকা চেকের বাহক পান এবং জরিমানার মাধ্যমে চেকের টাকা আদায় না হলে দেওয়ানী মামলাও দায়ের করা যায়। কোন কোম্পানী বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা হলে সংশ্লিষ্ট যিনি দোষী সাব্যস্ত হবেন তাকে শাস্তি ভোগ করতে হবে।


এনআই অ্যাক্টের এই সংশোধনীর ফলে ব্যাংকগুলো ঋণের জামানত হিসেবে পণ্য বন্ধকীর পরিবর্তে পোস্ট ডেটেড অর্থাৎ পর-তারিখের চেক গ্রহণে উৎসাহী হয়ে উঠেছে। তহবিল অপর্যাপ্ততার কারণে চেকের অমর্যাদা করা হলে ব্যাংক আইনি প্রতিকার চেয়ে আদালতের শরণাপন্ন হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে ব্যাংকের দাবি প্রতিষ্ঠা করা সহজতর হয়েছে। জেল-জরিমানার ভয়ে ঋণগ্রহীতারা অনেক ক্ষেত্রেই ঋণ পরিশোধে এগিয়ে আসছেন। কাজেই ঋণ অথবা অন্য কোনো দায় পরিশোধের জন্য চেক ইস্যু করার আগে এ ব্যাপারে নিশ্চিত হতে হবে যে, ব্যাংক হিসাবে পর্যাপ্ত স্থিতি রয়েছে। 

No comments:

Post a Comment